আমাজনের জঙ্গলের একটি রহস্যজনক ফুটন্ত নদী_Boiling River






 সারা দুনিয়ায় আলোড়ন ফেলে দিয়েছে আমাজনের জঙ্গলের একটি রহস্যজনক নদী। যা রুপকথার গল্পকেও হার মানায়। আমাজন নদীর অববাহিকায়, যে অংশে পেরুর রেইনফরেস্ট গড়ে উঠেছে, সেখানে রয়েছে আজব এক নদী। সে নদীতে পড়ে গেলে বিলীন হয়ে যায় মানুষসহ সকল প্রাণী! কোন প্রাণীরই অস্তিত্ব নেই এই নদীতে, থাকা সম্ভবও না। যে নদীর পানি ফুটতে থাকে সব সময়, যে নদীর পানির উত্তাপ টের পাওয়া যায় চার মাইল দূর থেকে

কীভাবে পৃথিবীবাসীর কাছে পরিচিতি পেল এ ফুটন্ত নদী?
পেরুর রাজধানী লিমার এক ছোট্ট ছেলে আন্দ্রেস রুজো, তার দাদার কাছে প্রায়ই শুনত এক লোককাহিনীর কথা.একবার ডিনারের সময়  তার দাদু তাকে মায়ানতুইয়াসু নদীটির গল্প বলেন। মেক্সিকো ও পেরুর স্পেনীয় শাসকের সৈন্যরা শেষ ইনকা শাসককে হত্যা করার পর সেনাপতির নেতৃত্বে আমাজনের জঙ্গলে ঢোকে সোনার খোঁজে। কোনও ক্রমে প্রাণ হাতে নিয়ে ফেরার পর সেনাপতি জানায়, জঙ্গলের মানুষখেকো সাপ, বিষাক্ত পানি ও ফুটন্ত নদীর অভিজ্ঞতা

ছোটবেলার স্বপ্ন সত্যি করতেই কিনা কে জানে, আন্দ্রেস রুজো বড় হয়ে ভূপদার্থবিদ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলল। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একজন তরুণ অভিযাত্রী সে। বড় হয়েই সে ঠিক করল, ছোটবেলায় শোনা গল্প কি আসলেই সত্যি নাকি জানতে হবে তাকে। তাই সে পেরুর গভীর জঙ্গলে অভিযানে বেরিয়ে পড়ল, ফুটন্ত নদীর রহস্য উৎঘাটনে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ২০১১ সালে সে সত্যি সত্যিই পেয়ে গেল এমন এক নদীর দেখা। নিজের চোখে দেখলেন সেই মরণফাঁদ। ছবিও তুলেছেন একাধিক। চারিদিক ধোঁয়ায় ভরা এলাকা। ছোট্ট নদীটি ক্রমাগত ফুটছে।
আন্দ্রের কথায়, নদীর পানি একটু ছুঁতেই যেন থার্ড ডিগ্রি লাগল। বুঝতে পারলেন এই নদী সাক্ষাৎ মৃত্যুর ফাঁদ। একটি মরা ব্যাঙকে ডুবিয়ে দেখলেন, এক সেকেন্ডে সিদ্ধ হয়ে গেল।
সে যখন ভূপ্রকৃতিবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা করছিল তখনই ফুটন্ত নদীর ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে থাকে। নানা তথ্য উপাত্ত, আর আমাজনে বিভিন্ন জায়গায় ভূমির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতে থাকে সে। কোথায় হতে পারে ফুটন্ত নদীর অবস্থান? ফুটন্ত নদীর ব্যাপারে সে তার শিক্ষক, কলিগ এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু সবাই ই তাকে নিরুৎসাহিত করে। প্রায় সবাই’ই বলে এটা কেবল একটা লোককাহিনী, একটা কাল্পনিক গল্প সকলের বক্তব্য, ফুটন্ত নদী থাকতে গেলে কাছাকাছি আগ্নেয়গিরি থাকতে হয়। তাপের উৎস না থাকলে, পানি গরম হবে কী করে?
একজন অধ্যাপক তো তাকে বলেই বসে, “বোকার মত প্রশ্ন করা বন্ধ কর, এটা তোমাকে খারাপভাবে উপস্থাপন করে।” অনেকেই হাসাহাসি করে তার বোকামি কৌতুহল দেখে। তবু, রুজোর কৌতুহল মেটে না। সে বিশ্বাস করতে থাকে, নিশ্চয়ই আছে কোথাও ফুটন্ত নদীর অস্তিত্ব। প্রকৃতি রুজোকে নিরাশ করেনি, তার কৌতুহল শেষ পর্যন্ত বাস্তবতায় রুপ নেয়। আন্দ্রেস রুজোর দেখানো পথেই পৃথিবীব্যাপী পরিচিতি পায় এ ফুটন্ত নদী।

কী কারণে এত উষ্ণ এ ফুটন্ত নদীর পানি?
পেরুর এই বয়েলিং রিভার বা ফুটন্ত নদীর পানির উষ্ণতা খুব যে অস্বাভাবিক তা নয়। পৃথিবীতে এর চেয়েও উত্তপ্ত নদীর অস্তিত্ব রয়েছে। কিন্তু সেই নদীগুলো আগ্নেয়গিরি হতে উৎপন্ন। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, পেরুর এই ফুটন্ত নদীটি আগ্নেয়গিরি হতে উৎপন্ন নয়। এ নদীর সবচেয়ে নিকটতম আগ্নেয়গিরিটি ৭০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে। তবে কি কারণ হতে পারে এ নদীর পানির অস্বাভাবিক তাপমাত্রার! কি রহস্য লুকিয়ে আছে এখানে!
একটা নির্দিষ্ট স্থানব্যাপীই কেবল এ নদীর তাপমাত্রা এত বেশি। এই ফুটন্ত নদীর পানি গিয়ে মিশেছে এক ঠান্ডা পানির স্রোতের সাথে। আবার মাঝে মাঝে রাতের দিকে কমেও যায় এ নদীর তাপমাত্রা। নদীর পানির তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ২৭ ডিগ্রি এবং সর্বোচ্চ ৯৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করে।
Boiling River, পেরু, রহস্যময়, উষ্ণ নদী
এ নদীটি ৯ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ হলেও ৬.২৪ কিলোমিটার এলাকায় পানির তাপমাত্রাই কেবল অনেক বেশি। শুকনো মৌসুমে তাপমাত্রা এত বেশি হয় যে সে তাপে যে কোন প্রাণী সেদ্ধ হয়ে যাবে। ছোট ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ বা উভচর প্রাণীতো হরহামেশাই পড়তে থাকে আর জ্যান্ত সেদ্ধ হতে থাকে এ নদীতে। এ স্থানে যেতে হলে প্রতি পদক্ষেপেই দরকার অতি সাবধানতা, কেননা সেখানকার সামান্যতম অসাবধানতাও মানুষকে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দুয়ারে।
ফুটন্ত নদীর প্রাচীন নাম ‘সানাই-টিমপিসকা’ যার অর্থ, ‘সূর্যের তাপে ফুটন্ত’। প্রাচীন নামানুসারে সূর্যের তাপকে এই উষ্ণ পানির জন্য দায়ী মনে করা হলেও, বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আসলে এ নদীর উষ্ণ পানির জন্য দায়ী এখানকার কিছু উষ্ণ প্রস্রবণ বা ঝরণা। আন্দ্রেস রুজোর মতে, মানুষের শরীরে যেমন শিরা-উপশিরার মধ্য দিয়ে রক্ত প্রবাহিত হয়, কোন ফাটল পেলে বাইরে বেরিয়ে আসে সে রক্ত। তেমনি, পৃথিবীর অভ্যন্তরেও রয়েছে উত্তপ্ত পানির প্রবাহ, ফাটল পেলে সেগুলো বাইরে বেরিয়ে আছে। সৃষ্টি হয় বিভিন্ন ভূতাপীয় অঞ্চলের। এমনই করেই ফুটন্ত নদীর আশেপাশের ঝর্ণা আর প্রস্রবণ থেকে গরম পানি বেরিয়ে এসে সম্ভবত সৃষ্টি হয়েছে এই ফুটন্ত নদীর।

বর্তমান অবস্থা
ফুটন্ত নদী নিয়ে গবেষণা এবং নদীটিকে রক্ষা করার জন্য আন্দ্রেস রুজো একটা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। নদী এবং নদীর আশেপাশের প্রাণীকুলকে রক্ষা করা এই প্রজেক্টের প্রধান উদ্দেশ্য। নদীর আশেপাশের বনাঞ্চল দিনে দিনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের অজ্ঞতা আর অসতর্কতার ফলে। যার ফলে বিপন্ন হতে পারে আন্দ্রেস রুজোর রুপকথায় পাওয়া এ আশ্চর্য নদী। তাই সে এ নদীর ঐতিহ্য আর অস্তিত্ব বাঁচাতে কাজ করে যাচ্ছে অবিরত।

নদী নিয়ে লোককথা ও স্থানীয় বিশ্বাস
কাল্পনিকতা, আধ্যত্বিকতা আর রহস্যময়তায় ঘেরা এই ফুটন্ত নদীটিকে পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করে এ অঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারা।
Boiling River, পেরু, রহস্যময়, উষ্ণ নদী
অ্যামাজনের যে অংশে ফুটন্ত নদী রয়েছে, সে অঞ্চলে দুটি ওঝা সম্প্রদায়ের বাস। এর একটির নাম মায়ানতুয়াকু (Mayantuyacu), অন্য সম্প্রদায়টির নাম সানতুয়েরিয়ো হুইসটিন (Santuario Huistin)। মায়ানতু হলো জঙ্গলের এক আত্মা, যার মাথা ব্যাঙের মত, কিন্তু শরীরটা টিকটিকি সদৃশ। মায়ানতুর হাত-পা দেখতে কচ্ছপের হাত-পায়ের মত। জঙ্গলের উপকারী আত্মা এই মায়ানতু। ইয়াকু অর্থ পানি। লোককাহিনী মতে, ফুটন্ত নদীটিতে অনেক শক্তিশালী আত্মার অস্তিত্ব রয়েছে। এ কারণেই খুব শক্তিশালী ওঝা ছাড়া এই নদীতে প্রবেশ করা অসম্ভব। এ কারণেই সাধারণ লোকেরা এ নদীতে একা যেতে ভয় পায়। পুরো জঙ্গলেই ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন আত্মারা, তাদের মধ্যে রয়েছে সর্প আকৃতির ইয়াকুমামা, যে কিনা নদীর গরম ও ঠান্ডা পানিতে জন্ম নেয়।

মন্তব্যসমূহ